বাগদা চিংড়ির নার্সারি বলতে বোঝায় যেরের এমন একটি স্থান যেখানে চিংড়ির পোনাকে ১৫-২০ দিন য সহকারে লালন পালন করে মূল ঘেরে ছাড়ার উপযোগী করে তৈরি করা হয়। নার্সারি পুকুর সাধারণত মংস্যকুক বা অবাঞ্ছিত প্রাণিমুক্ত, প্রাকৃতিক খাবার সমৃদ্ধ, দূষণ ও রোগজীবাণু মুক্ত, কম গভীরতা সম্পন্ন ছোট আকারের হয়ে থাকে। নার্সারি পুকুরের আয়তন সাধারণত উৎপাদন পুকুরের দশ ভাগের এক ভাগ হয়ে থাকে। চিংড়ির পোনার আকার তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ার সরাসরি পুকুরে মজুদ করলে গভীরতাজনিত কারণে গোনা যারা যেতে পারে। এছাড়া পরিবেশের তারতম্য, পোস্ট লার্ভার পীড়ন, পরিবহণজনিত ধকল, ঠিক খাপ না খাওয়ানোর কারণেও পোনা মারা যেতে পারে। তাই চিংড়ি পোনার বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধির নার্সারি ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘেরে অল্পদিনের জন্য নার্সারি পুকুর তৈরি করে পোনা লালন পালন করলে পোনার বেঁচে থাকার হার অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
চিত্র-৩.১ বাগদা চিংড়ির নার্সারি পুকুর
দেশের চিংড়ি চাষিরা হ্যাচারি ও প্রাকৃতিক উভয় উৎস থেকেই বাগদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করে থাকে। পোনাগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ, পরিবহণ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করলে মজুদকালীন অথবা মজুদ পরবর্তী সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পোনা মারা যেতে পারে। তাই চিংড়ি হ্যাচারি থেকে সংগৃহীত ছোট আকারের পোনা মজুদ পুকুরে ছাড়ার পূর্বে পোনাকে বড় ও সবল করে তোলার জন্য নার্সারি পুকুরে যত্ন সহকারে পরিচর্যা করতে হয়। একাজ করার উত্তম উপার হলো মার্সারি পুকুরে পোনার বর নেওরা। নার্সারি পুকুরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উল্লেখ করা হলো-
ক) বাগদা চিংড়ির পোনার যত্ন ও পরিচর্যা ভালোভাবে নেওয়া যায়
খ) ঘেরের পরিবেশের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
গ) সহজ উপায়ে পোনাকে খাবার প্রদান করা যায়।
ঘ) প্রয়োগকৃত খাবার পোনা সহজে খুঁজে পায়। উৎপাদন পুকুরে সরাসরি পোস্ট লার্ভা মজুদ করার চেয়ে নার্সারি পুকুরে অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ করলে খাদ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
ঙ) পোনা সুস্থ স্বাভাবিক ও শক্তিসম্পন্ন হয়।
চ) সরাসরি মজুদ পুকুরে পোনা মজুদের চেয়ে নার্সারি পুকুরে লালন করলে পোনার মৃত্যুহার কম হয়।
ছ) চিংড়ির পোনার বেঁচে থাকার হার সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়।
জ) নার্সারি পুকুরে পোনার সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ ভালো হয়।
ঝ) উৎপাদন পুকুরে অতিরিক্ত মজুদ ঘনত্ব এড়ানো সম্ভব হয়।
ঞ) চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাপের পোনা সময়মত পাওয়া যায়।
ট) পালন পুকুরে চিংড়ি পোনার মজুদ ঘনত্ব স্থিতিশীল অবস্থায় রাখা যায়।
ঠ) অবাঞ্ছিত বা রাক্ষুসে প্রাণির হাত থেকে চিংড়ি পোনাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
ড) নার্সারি পুকুরে প্রতিপালনের ফলে চিংড়ি চাষির আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে, এবং
ঢ) নার্সারি ব্যবস্থাপনা ভালো হওয়ায় চিংড়ির রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
নার্সারি পুকুরের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন-
ক) মাটির পানি ধারণ ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে দোঁআশ, এটেল বা বেলে দোঁআশ মাটি নার্সারি পুকুর তৈরি করার জন্য উপযুক্ত।
খ) যে জায়গার মাটি মোটামুটি ভালো গুণসম্পন্ন এবং পাড়ের কাছাকাছি জায়গায় নার্সারি পুকুর তৈরি করা উচিত।
গ) ঘেরের যে অংশটি তুলনামূলকভাবে গভীর ও পাহারা দেওয়ার জন্য সুবিধাজনক সে জায়গায় নার্সারি স্থাপন করা ভালো।
(ঘ) মাটির পিএইচ ৫-৬ এর মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে মাটি অম্লীয় হলে চুন প্রয়োগের মাধ্যমে তা উপযুক্ত করে নিতে হবে
নার্সারি পুকুর ভালোভাবে তৈরি করা হলে পোনার মজুদকালীন মৃত্যুহার কমে যায় এবং পোনার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয় -
ক) নার্সারি পুকুরে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি থাকা প্রয়োজন।
খ) ঘন জাল দিয়ে নার্সারি তৈরি করতে হবে।
গ) নার্সারির জাল তলার মাটিতে কমপক্ষে ৫-৬ ইঞ্চি পরিমাণ গভীরে পুঁতে দিতে হবে এবং পানির উপরে ১ হাত পরিমাণ বেশি রাখতে হবে। জাল যেন বাতাসে পড়ে না যায় সেজন্য বাঁশের খুঁটির সাথে শক্ত করে বেধে দিতে হবে।
ঘ) নার্সারির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শুকনো লতা-পাতা, গাছের ডাল দিয়ে চিংড়ির আশ্রয়স্থল তৈরি করে দিতে হবে। এতে একদিকে যেমন পোনার আশ্রয়স্থল হবে অন্যদিকে জন্মানো পেরিফাইটন পোনার প্রাথমিক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
ঙ) নার্সারির মাটি বা তলদেশ সমতল হওয়া ভালো।
চ) ঘেরের যে কোনো একপাশে বাঁশ বা বাঁশের চট ও নাইলনের জাল দিয়ে ঘিরে ঘেরের মোট আয়তনের ৫-৭ ভাগ আকারের নার্সারি তৈরি করতে হবে।
নার্সারি পুকুরের আয়তন সাধারণত উৎপাদন খামারের দশ ভাগের এক ভাগ হওয়া উচিত। তবে একটি নার্সারি পুকুরের আয়তন ৫০০ বর্গমিটার হলে ভালো। নার্সারির আকার বা আয়তন নির্ভর করে মূলত নার্সারির ধরন, পোনা মজুদের পরিমাণ, পালন ঘেরের আয়তন, নার্সারিতে পোনা কত দিন রাখা হবে ইত্যাদির ওপর। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত-
ক) যদি পালন ঘের এক বিঘা বা ৩৩ শতাংশ হয় তাহলে নার্সারি পুকুরের আয়তন হবে ৩-৫ শতক।
খ) নার্সারি পুকুরের আয়তন এক বিঘার বেশি হওয়া উচিত নয়। যদি দরকার হয় তাহলে বড় ঘেরের ক্ষেত্রে কয়েকটি নার্সারি পুকুর তৈরি করা যেতে পারে।